 
							 আমি ফেইসবুকে মজে থাকি
 কখনো দুঃখ তাড়ানোর জন্য। হয়তো অতি বিজ্ঞজন এটাকে ফাজলামো ভেবে নেবেন। 
কেননা ফেইসবুক এখন মানুষকে বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিচ্ছে এমন ঘোরতর অভিযোগ 
চারদিকে। কিন্তু ফেইসবুক ব্যবহার করতে করতে একটা কথা ভাবি, ফেইসবুক না 
থাকলে কতো আগে আমিও জীবনানন্দের মতো আত্মহনন করতাম!
 তাই ফেইসবুকে এলেই 
জীবনানন্দ দাশের কথা প্রায় স্মরণ আসে তাঁর অন্যতম কারণ - আমিও কবিতা লেখার 
চেষ্টায় আছি বুদ্ধিবয়স থেকে। তাও আবার জীবনানন্দ দাশের তৈরি করা পথের পথিক 
হয়ে...!
 অথচ কবিতা শিক্ষা কেউ আমাকে দেয়নি। তাহলে এই কবিতা লেখার অসুখ 
কোত্থেকে এলো,এটাই হয়তো আজীবন প্রশ্ন থেকে যাবে নিজের কাছেও। জীবনানন্দেরও 
এই অসুখটাই কী আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছে...? আচ্ছা,এই অসুখটা থেকে কী কখনো
 ফেরা যায়...? আমি বলবো,কখনোই যায় না। বরঞ্চ এই অসুখটাকে যত্নে পুষে,বরঞ্চ 
কবিতা লিখতে না পারলে নিজের মধ্যে নিজে নিঃস্ব হয়ে পায়চারি করতে থাকে। কোনো
 অমৃত বা ধনসম্পদে আর ভালো লাগে না। সত্যিকারের কবিদের কবিতা লেখা ছাড়া আর 
কোনো কাজ ঠিকমত করাও হয়ে ওঠে না। কবিতা ছেড়ে একজন কবি কোথাও আছেন,নিশ্চিত 
ভেবে নিন সেখানে ফাঁকি দিচ্ছে। এটা সংসার, চাকরিতে বা যেকোনো কাজে...
 
কবিকে ধরে রাখবে এমনজনাও জন্মেনি। হয়তো ছাড় দিয়ে সমাজের আড়ালে চলতে থাকে 
দুর্বিষহ উৎপাত। তাই সমাজ- দেশের বিজ্ঞজন যখন বলেন- ফেইসবুক মানুষকে সমাজ 
পরিবার থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। আর তখন আমার ভাবনায় আসে - স্বয়ং জীবনানন্দ! 
ফেইসবুক স্ক্রিনের ঢেউয়ে খেলে যায় জীবনানন্দের ভারকরা মুখ...
 মন কেঁদে 
ওঠে। বেচারা যদি এই সময়ে জন্মাতেন।  হয়তো আমার মতোই ফেইসবুকে দুঃখ ঝাড়তে 
পারতেন স্ট্যাটাস লিখে। তাঁর গুণগ্রাহী লাইক - কমেন্ট ও শেয়ারে মাতিয়ে 
রাখতো কবিকে। স্ত্রীর বা যেকারো অবজ্ঞা - তাচ্ছিল্যকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে 
পারতেন সেলফিতে মজে। হয়তো গোপনে ইনবক্সে সেই দু'দণ্ড শান্তি দেওয়া নাটোরের 
বনলতা আসতেন। কবি যখন কবিতায় লিখলেন- ' হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি 
পৃথিবীর পথে, অথবা -' আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন'...
 কবির লেখায় এসব শুনে প্রায় ইনবক্সে এসে সান্ত্বনা দিতে পারতেন স্বয়ং বনলতা
 সেন। সাহস দিতেন। উৎসাহ দিতেন। বাঁচার প্রেরণাও দিতেন। হয়তো গোপন ইনবক্স 
থেকে একসময় সম্মুখে দাঁড়াতেন। সমাজ বা স্ত্রীর থেকে আলাদা এক গোপনে - 
অভিসারে জীবনানন্দ তাঁর আকাঙক্ষিত বনলতা সেনের সাথে শরীরী কাব্যে 
জড়াতেন...ওফ্,ভালো হতো,ভালো হতো সেই শিহরণ আমারও জাগছে।
 ভাবছি,তবুও তো ভালো থাকতেন আমাদের প্রিয় জীবনানন্দ দাশ....
০২.
 কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে; কবিতা আমরা
 অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা 
সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে 
না।
       - কবিতার দুর্বোধ্যতা /বুদ্ধদেব বসু)
 সত্য কথা এই, 
রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে বের হয়ে নিজের জাত চেনার প্রথম সফল কবি জীবনানন্দ 
দাশ। এটা করতে কী পরিমাণ সাহস বা কবিত্ব শক্তি,  নিজেকে গড়ে তোলার পরিশ্রম 
কেমন হতে পারে তা অকল্পনীয়। নতুন কিছু জিনিস বা বিষয় প্রথমে প্রথমে সবার 
কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। কিন্তু জীবনানন্দের কী পরিমাণ লেখার প্রতি প্রীতি 
যে,সবার অবজ্ঞা সহ্য করেও এমন পথটি বাতলে দিলেন আর আধুনিক কবিতা বলতে সবাই 
জীবনানন্দকেই বুঝে। পরিবার সমাজ, এমনকি যাঁরা বুঝবার লোক জীবনানন্দের 
ভেতরের জ্বালার কথা। সেই লেখকসমাজও তাঁকে হেয় - অবজ্ঞা করে গেলেন। 
লেখকসমাজের অনেকে হয়তো বুঝে গেছে - জীবনানন্দ হবে আধুনিক কবিতার জীবন্ত 
কিংবদন্তী,তাই হয়তো বিভিন্নভাবে আটকাতে চেয়েছেন। স্বীকৃতি পেয়ে গেলে 
লেখকসমাজ নিজেদের জৌলুস হারানোর ভয়ে অস্থির ছিলেন বুঝি। যেখানে 
রবীন্দ্রনাথও জীবনানন্দের কবিতা সম্বন্ধে রূঢ় মন্তব্য করেছেন। ১৯১৫ সালে 
মাত্র ষোল বছর বয়সে কিছু কবিতা যখন রবীন্দ্রনাথকে পড়তে দিয়েছিলেন, সেই 
কবিতা পড়ে মন্তব্যও লিখলেন- ‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র 
নেই-কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের 
মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি 
আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়ীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে । জোর
 দেখানো যে জোরের প্রমাণ। তা নয় বরঞ্চ উল্টো ।’
 আমি মনে করে, প্রকৃতির 
রহস্যময় অপার সৌন্দর্যের কবিকে রবীন্দ্রনাথও বুঝতে সক্ষম হন নি নয়তো 
রবীন্দ্রনাথ নিজের জনপ্রিয়তার সাম্রাজ্যে অন্য কারো পদচারণা মেনে নেননি। 
এরকম আচরণ কবিদের মাঝে এখনও অহরহ,তাই অনুমান করাই যায়। যেখানে 
রবীন্দ্রনাথের এমন মন্তব্য, সেখানে অন্য লেখকরাও বিমুখ থাকবেন নিঃসন্দেহে। 
এবং জীবনানন্দ দাশের অমন অন্তর্জ্বালা বয়ে চলায় লেখকদের রূঢ় আচরণ 
সর্বাপেক্ষা স্মরনীয় ও নিন্দনীয় বটে। এর কারণ তিনি যেমন প্রচারবিমুখ 
ছিলেন,তেমনি সাহিত্যকর্ম নিয়ে হাটে ময়দানে হট্টগোলে,মিছিলে নামেন নি। তবে 
একজন নিভৃতচারী কবিও মেনে নিতে পারেন না - নিজের কবিত্ব শক্তিকে কেউ 
অবজ্ঞার চোখে দেখুক। যদি এই অবজ্ঞা করা ব্যক্তি একজন কবি হন,এটার 
অন্তর্জ্বালা বহুগুণে বেড়ে যায়। কেননা একজন কবির আত্মত্যাগ আরেকজন কবিই তো 
সহজে অনুমান করতে পারে।
 অথচ সেদিনের উপেক্ষিত এই কবির কাব্যকে নিয়ে আজ 
যতই বিচার- বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হচ্ছে ততোই এর ভাবের গভীরতা, অনুভূতির 
তীক্ষ্ণতা, চিন্তা - চেতনার সূক্ষ্মতম ভাব,বিষয়ে বিশালত্ব ও ব্যাপকতা এবং 
বিন্যাস, উপমা,উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও চিত্রময়তার প্রাতিস্বিকতায় আমরা এখন
 প্রতিনিয়ত বিস্মিত। এক্ষেত্রে জীবনানন্দকে প্রথম আমাদের সামনে তুলে ধরা 
বুদ্ধদেব বসু লিখলেন -
 ১. জীবনানন্দ দাশ বাঙলা কাব্য সাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছে বলে আমার মনে হয়। 
 ২. তিনি একজন খাঁটি কবি। প্রমাণস্বরূপ একটি লাইন বলছি -
 'আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশ'।
 ... আকাশের অন্তহীন নীলিমার দিগন্তবিস্তৃত প্রসারের ছবিকে একটি লাইনে এঁকে
 দিয়েছে - একেই বলে  magic line।  আকাশ কথাটার পুনরাবৃত্তি করবার জন্যই 
ছবিটি একেবারে স্পষ্ট,সজীব হয়ে উঠেছে; শব্দের মূল্যবোধেরর এমন পরিচয় খুব কম
 বাঙালি কবিই দিয়েছেন।"
 ০৩. 
 নির্জনতার কবি,বিষণ্নতার 
কবি,একাকিত্ব ও যন্ত্রণার কবি এসব অভিধাগুলো জীবনানন্দ দাশ নিজেও পছন্দ 
করতেন না। তাই নিজের সম্পর্কে মন্তব্যও করেছেন - আমার কবিতা সম্বন্ধে নানা 
জায়গায় নানারকম লেখা দেখেছি ; মন্তব্য শুনেছি ; প্রায় চৌদ্দ আনি আমার কাছে 
অসার বলে মনে হয়েছে..."
 স্বয়ং জীবনানন্দ দাশের অসার ভাবনাটাই এখন সবার 
কাছে আর ভাবনা নয়,সুস্পষ্ট। তবে তাঁর মৃত্যুর পরে এসব হা-হুতাশ বিরক্তিকর। 
যখন ভূমেন্দ্র গুহের লেখা পড়লাম জীবনানন্দের মৃত্যুর পরবর্তী তাঁর ছবি 
নিয়ে, তখন তাঁর স্ত্রীর কথাগুলো কানে নয় অন্তর বিষিয়ে তুলে আমাদের -
 জীবনানন্দের শ্রাদ্ধবাসরে রাখার জন্য তার একখানা ভালো ছবি কারও কাছে পাওয়া
 যাচ্ছিল না, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের কারও কাছে ছিল না, এমনকি যে বোন সুচরিতা
 দাশ প্রায়ই ছবি তুলতেন, তার কাছেও কবির কোনো ছবি নেই। শেষ পর্যন্ত লাবণ্য 
দাশের কাছে ছবি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ভূমেন্দ্র গুহকে ‘কিঞ্চিৎ 
অবজ্ঞার সুরেই প্রায় বলেছিলেন, মনে পড়ছে, আমার কাছে নেই অন্তত, তা ছাড়া ওই 
ছবি-টবি তোলানো-টোলানো নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা কোনো দিন বিশেষ ছিল না। 
তোমাদের দাদা দেখতেও তো এমন কিছু রাজপুত্তুর ছিলেন না।’
                  - ভূমেন্দ্র গুহ) 
জীবনান্দ দাশের একটা ভালো ফটো তোলা না থাক,এখন কোটি-কোটি জনের অন্তরের মাঝে হাজারে ফটো গাঁথা জীবনান্দের। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৫৪ সালের ১৪ ই অক্টোবর জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন এবং ২২ শে অক্টোবরে পরলোকগমন করেন। আহতাবস্থায় ৮ দিনের সমূহ যন্ত্রণা এখন প্রত্যেক কবির কবিতা লেখার অনুপ্রেরণাও। ভাবছি ফেইসবুকের গোপন ইনবক্সে যদি জীবনানন্দ দাশ অভিমান ভুলে একবার নক দিতেন - হ্যালো....
